স্বপ্নানল : মৃত্তিকা সান্যাল ফণী



সালটা ১৯৩৪... ১২ জানুয়ারি... ৪ নম্বর স্টীমার ঘাটের দিকে এগিয়ে আসছে একটা ট্রাক স্বাধীনতার স্বপ্নকে নিজের মধ্যে বন্দী করে নিয়ে... কিছুক্ষণের মধ্যেই এ স্বপ্ন আবার মুক্ত হতে চলেছে... মুক্তিদাতার ভূমিকায় ব্রিটিশ ক্রুজার 'দ্য রিনাউন'... আকাশে বাতাসে তখনও অনুরণিত হচ্ছে আগের রাতে বিনোদ বিহারী চৌধুরীর সুরহীন গলার অসাধারণ ভাবাবেগে গাওয়া কবিগুরুর গান- 'তবে বজ্রানলে আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে একলা জ্বলো রে...' কিন্তু এ বজ্রানল না কি স্বপ্নানল? প্রশ্নচিহ্ন...


"সময়টা সন্ধ্যে আটটার বদলে দশটা করতে হবে... সংগ্রামের অঙ্ক, সময়ের অঙ্ক সবই অনেক হিসেব করে কষতে হয়..."- তরুণ বিপ্লবীর কথা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছেন অভিযানে অংশ নেওয়া সদস্যরা। শীর্ণবাহু, শীর্ণ পদযুগল, অথচ দৃপ্ত দৃষ্টি... বলিষ্ঠ পদসঞ্চালনা... "প্রথমেই রেললাইনের ফিসপ্লেট খুলে ফেলতে হবে... টেলিফোন আর টেলিগ্রাফ অফিস আক্রমণের পর কি করতে  আশা করি বুঝে গেছেন। একদম নিশ্চিহ্ন করে দেবেন। মনে রাখবেন চট্টগ্রামকে বাংলাদেশের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়াই কিন্তু আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য। রেলওয়ের অস্ত্রাগার আর পুলিশ রিজার্ভ ব্যারাক দখল- আমাদের মূল লক্ষ্য। যাঁরা দায়িত্বে আছেন তাঁদের অনুশীলন সম্পূর্ণ হয়েছে আশা করছি... বন্দে মাতরম!" এরপর সম্মিলিত কণ্ঠে আরও একবার ধ্বনিত হল- "বন্দে মাতরম!"


চারদিনের স্বাধীন চট্টগ্রাম... মননে ব্রিটিশ শাসনমুক্ত বাসিন্দাসংখ্যা পঁয়ষট্টি... প্রতিনিয়ত স্বাধীনতার অঙ্ক কষে চলা প্রশান্ত দুটো চোখে হঠাৎই সাফল্যের আগুন জ্বলে উঠল। নিরীহ অঙ্কের শিক্ষকের স্বপ্নানলে আলোকিত হল বাকীরা। "এই মুহূর্তে আমরা প্রত্যেকে সম্পূর্ণভাবে ব্রিটিশ শাসনমুক্ত। চট্টগ্রামের এই মাটি এই মুহূর্তে ব্রিটিশ সংযোগমুক্ত। বন্দে মাতরম, বন্দে মাতরম, বন্দে মাতরম..."- উত্তোলিত হল পতাকা। সম্মিলিত কণ্ঠে আবারও ধ্বনিত হল 'বন্দে মাতরম'।


মাস্টারের চোখের স্বপ্নানলে কতকিছু পুড়ে খাক হয়ে গেছে... পুড়ে খাক হয়ে গেছে উজ্জ্বল ভবিষ্যত... পুড়ে খাক হয়ে গেছেন চোখে এক পৃথিবী স্বপ্ন নিয়ে মাস্টারের ঘর করতে আসা পুষ্পকুন্তলা দেবী... জীবনের অঙ্কে কিন্তু অঙ্কের মাস্টারমশাই ডাহা ফেল! বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজ যা কি না বিপ্লবীদের গোপন ঘাঁটি আর সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী, শিক্ষক- পরিচয়ের আড়ালে যিনি কি না দেশের মুক্তির যোদ্ধা- মাস্টারের জীবনদর্শনের রূপপরিবর্তক... বিনা বারুদে জ্বলে ওঠা আগুন আজও জ্বলছে দাউদাউ করে।


১৯৩০ এর ২২ এপ্রিল... চারদিনের স্বাধীনতার শেষ সময় আগত... ৬৫ জনের বাহিনীর দুর্গ এখন পাহাড় জালালাবাদ। লুঠের অস্ত্র দিয়েই শুরু হল শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই। একের পর এক ব্রিটিশ সৈন্যকে শেষ করে দেশমাতৃকার জয়গান গাইতে গাইতে  মায়েরই কোলে লুটিয়ে পড়লেন মতিলাল কানুনগো। এরপর একে একে আরও যাঁরা লুটিয়ে পড়লেন প্রতেকেরই জড়দেহে প্রত্যয়ের ছাপ স্পষ্ট। মাস্টারের যে লুটিয়ে পড়লে চলবে না। এখনও অনেক লড়াই বাকী। ২৪ এপ্রিল... প্রতিপক্ষের সমস্ত চেষ্টাকে ব্যর্থ করে ১৬ জন সঙ্গীকে নিয়ে পালাতে সমর্থ হলেন শীর্ণ পদযুগলের  বলিষ্ঠ মাস্টারদা। 


পাঁচ হাজার টাকা পুরষ্কারের লোভে বহু চোখ যখন মাস্টারদার খোঁজে, মাস্টারদা তখন অঙ্ক কষতে ব্যস্ত। লক্ষ্য এবার ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমন। যে নারী এতদিন আড়ালে থেকে মুক্তযুদ্ধে সহায়তা করেছে সেই নারীরই এবার পর্দার বাইরে আসার পালা।


"বাংলায় বীর যুবকের আজ অভাব নাই। বালেশ্বর থেকে জালালাবাদ, কালারপোল পর্যন্ত এদের দৃপ্ত অভিযানে দেশের মাটি বারে বারে বীর যুবকের রক্তে সিক্ত হয়েছে। কিন্তু বাংলার ঘরে ঘরে মায়ের জাতিও যে শক্তির খেলায় মেতেছে, ইতিহাসে সে অধ্যায় আজও অলিখিত রয়ে গেছে। মেয়েদের আত্মদানে সে অধ্যায় রচিত হোক এই-ই আমি চাই। ইংরেজ জানুক, বিশ্বজগৎ জানুক, এদেশের মেয়েরাও মুক্তিযুদ্ধে পেছনে নেই”।


প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার মাস্টারদার পা ছুঁয়ে বেরিয়ে পড়লেন... ২৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৩২... একজন নারীর নেতৃত্বে বিপ্লবী বাহিনী হতাহত করে প্রতিপক্ষের তিপ্পান্ন জনকে। ব্রিটিশের হাতে ধরা দেবেন না বলে বীরাঙ্গনা সাহায্য নেন পটাশিয়াম সায়ানাইড নামক রাসায়নিকের।


মাস্টারকে জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় ধরার চেষ্টা অব্যাহত। পুরষ্কারমূল্যও বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে... পাঁচ হাজারটা বেড়ে হয়েছে দশ হাজার... ১৯৩৩ এর ১৬ই ফেব্রুয়ারি... গৈরলা গ্রামে ক্ষীরোদপ্রভা বিশ্বাসের বাড়িতে চলছে বিপ্লবী বৈঠক। বৈঠকে উপস্থিত বিপ্লবী ব্রজ সেনও... এই ব্রজ সেনেরই সহোদর নেত্র সেনের বিশ্বাসঘাতকতায় সেই রাতেই ধরা পড়লেন মাস্টারদা সূর্যকুমার সেন। প্রতিটা সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় একই খবর... আনন্দবাজার পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হল- "চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন সম্পর্কে ফেরারী সূর্য সেনকে গত রাতে পটিয়া হইতে ৫ মাইল দূরে গৈরলা নামক স্থানে গ্রেপ্তার করা হইয়াছে। সূর্য সেনকে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের মামলায় প্রধান আসামি বলিয়া অভিহিত করা হইয়াছে। গত ১৯৩০ সাল হইতে সূর্য সেন পলাতক ছিলেন এবং তাঁহাকে ধরাইয়া দিবার জন্য গভর্নমেন্ট দশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করিয়াছিলেন।"


শুরু হল বিচার... ব্রিটিশের হাতে পড়া মাস্টারদার অর্ধসমাপ্ত আত্মজীবনী 'বিজয়া' ই হল সূর্যকুমার সেনের বিরুদ্ধে সর্বোৎকৃষ্ট প্রমাণ। ঘোষিত হল ফাঁসির সাজা। দিন নির্ধারিত হল ১৯৩৪ এর ১২ জানুয়ারি। কনডেমড সেলে কড়া প্রহরায় সূর্য সেন... এক কয়েদি মেথর মাস্টারদার চিঠি পৌঁছে দিচ্ছেন বাকী সেলগুলোতে। অন্ধকার কুঠুরিগুলোতে প্রতিনিয়ত উচ্চারিত হচ্ছে বিপ্লবের মন্ত্র। মৃত্যুর আগে জেলে বন্দী বিপ্লবী কালীকিঙ্কর দে-এর কাছে মাস্টারদা পেন্সিলে লেখা একটি বার্তা পাঠান- "আমার শেষ বাণী- আদর্শ ও একতা।" মাস্টারদা গান শুনতে চাওয়ায় কল্পনা দত্তের আদেশে বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী তাঁর সেলে বসেই গান ধরলেন- 'যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে...'


১৯৩৪ এর ১২ জানুয়ারি... মধ্যরাত... বারংবার হাতুড়ির আঘাতে মৃতপ্রায় দুটি দেহ নিয়ে যাওয়া হল ফাঁসির মঞ্চে... মাস্টারদা সূর্য সেন আর তারকেশ্বর দস্তিদার... ট্রাকে করে চার নম্বর স্টীমার ঘাটের দিকে চলেছে দুই বিপ্লবী দেহ। ব্রিটিশ ক্রুজার 'দ্য রিনাউন' অপেক্ষমান। অপেক্ষা এই দেহ দুটিকে মাঝসমুদ্রে ফেলে দেওয়ার। এরপর হিন্দুমতে নির্বাণ না পাওয়া দুটি সত্তার পুনর্জাগরণে সমুদ্রেও জ্বলে উঠল আগুন। ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির 'বন্দে মাতরম' ধ্বনিতে কেঁপে উঠল ব্রিটিশ সত্তা। অব্যাহত থাকল লড়াই...

Post a Comment

Previous Post Next Post